নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমের চিত্রায়ণে দেশে তিনি ‘দেবতা’। কিন্তু এই একই ব্যক্তিই আবার পশ্চিমাদের চোখে ‘খেয়ালি একনায়ক’। ঘরে-বাইরে উত্তর কোরিয়ার সদ্য প্রয়াত নেতা কিম জং ইলের পরিচিতি এমনই।
দেশটির গণমাধ্যমসহ প্রচারণার অন্যান্য মাধ্যমে সব সময়ই কিম জং ইলকে অত্যন্ত জনপ্রিয় ও পূজনীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবেই দেখানো হতো। তাঁর সম্পর্কে বলা হয়, তিনি ‘দেবতুল্য নেতা’। তবে পশ্চিমারা তাঁকে সব সময়ই চিহ্নিত করেছে এক ‘বদমেজাজি জালিম’ শাসক হিসেবে।
উত্তর কোরিয়ার গণমাধ্যমে আজ সোমবার বলা হয়েছে, দেশটির নেতা কিম জং ইল ৬৯ বছর বয়সে গত শনিবার হূদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। তবে তাঁর জন্মস্থান ও প্রকৃত বয়স নিয়ে রয়েছে নানা বিতর্ক।
উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় প্রচারণার মতে, কোরিয়ার বিখ্যাত পায়েকতু পর্বতের কাছে পিতা কিম ইল সাংয়ের (Kim Il-sung) নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহী সেনাদের এক গোপন শিবিরে ১৯৪২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি কিম জং ইলের জন্ম। তবে কেউ কেউ বলেন, তাঁর বাবা ও অন্যান্য কোরিয়ান কমিউনিস্টরা সামরিক ও অন্যান্য প্রশিক্ষণের জন্য সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সাইবেরিয়াতে অবস্থানকালে তাঁর জন্ম হয়।
১৯৫০-৫৩ সালে সংঘটিত কোরিয়াযুদ্ধের সময় নিজেকে নিরাপদ রাখতে কিম জং ইল ওই সময়টা চীনে কাটিয়েছেন। বলা হয়, তিনি পিয়ংইয়ংয়ে তাঁর বাবার নামে প্রতিষ্ঠিত কিম ইল সাং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেছেন এবং সেখানেই কমিউনিস্ট বিপ্লবের দীক্ষা নিয়েছেন।
১৯৯৪ সালে কিম ইল সাংয়ের মৃত্যু হলে দেশটিতে সরকারিভাবে তিন বছরের জন্য শোক পালন করা হয়। বাবার মৃত্যুর পর কিম জং ইল সমাজতান্ত্রিক এ দেশটির ক্ষমতার হাল ধরেন। সেই সঙ্গে নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তিনি বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন।
কিম ইল সাংকে কোরিয়ার জনক, মহান নেতা ও চিরন্তন প্রেসিডেন্ট হিসেবে অভিহিত করা হয়। এ কারণে ছেলে কিম জং ইল কখনোই দেশটির প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেননি। এই পদটি ছিল কেবল তাঁর বাবার জন্যই সংরক্ষিত।
ক্ষমতা গ্রহণ করে তিনি তাঁর বাবার গৃহীত ‘সামরিক বাহিনীই প্রথম’ নীতি বিশ্বস্ততার সঙ্গে পালন করেন। এ নীতি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে তিনি দেশের অধিকাংশ সম্পদই সামরিক খাতে নিয়োজিত রেখেছেন। এমনকি দেশটিতে চরম দুর্ভিক্ষ চলাকালেও তাঁর এ নীতির বাস্তবায়ন অব্যাহত ছিল। এই নীতির মাধ্যমেই তিনি উত্তর কোরিয়ায় বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম সেনাবাহিনী গড়ে তুলেছেন।
কিম জং ইল ছিলেন তাঁর দেশে পরমাণু অস্ত্র গড়তে উদ্যোগী ছিলেন। ২০০৬ সালের অক্টোবরে প্রথমবারের মতো উত্তর কোরিয়া পরমাণু অস্ত্রের পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ ঘটায়। একই ধরনের অন্য একটি পরীক্ষা চালানো হয় ২০০৯ সালে। ফলে দেশটির ওপর জাতিসংঘ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। বলতে গেলে, পরমাণু ইস্যুকে কেন্দ্র করে উত্তর কোরিয়া ছিল পুরোপুরি একঘরে।
অপশাসন, জনগণের ওপর নিপীড়ন ও পরমাণু অস্ত্র গড়তে উত্তর কোরিয়ার প্রচেষ্টার পরিপ্রেক্ষিতে ২০০২ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ দেশটির তীব্র সমালোচনা করেন। ইরান ও ইরাকের সঙ্গে তিনি উত্তর কোরিয়াকে ‘শয়তানের অক্ষ’ বলে অভিহিত করেন। উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং ইলকে একজন ভয়ংকর মানুষ বলেও অভিহিত করেছিলেন বুশ।
কিম জং ইলের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে খুব একটা তথ্য পাওয়া যায় না। তবে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেডলিন অলব্রাইট তাঁর অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কিম জং ইলকে ‘বিচিত্র’ মানুষ বলে অভিহিত করেছেন। অলব্রাইটের দৃষ্টিতে কিম ছিলেন বুদ্ধিমান ও জ্ঞানী মানুষ।
তবে সমালোচকদের মতে, বাবার মতোই কঠোর হাতে দেশ পরিচালনা করেছেন কিম। বিরোধীদের তিনি নির্মমভাবে দমন করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা কমিটি ফর হিউম্যান রাইটসের হিসাবে উত্তর কোরিয়ার কারাগারে প্রায় দুই লাখ রাজবন্দী আছে।
এক হিসাবে বলা হয়েছে, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষে দেশটির প্রায় ২০ লাখ মানুষ মারা গেছে। এ পরিস্থিতিতেও কিম তাঁর দেশে বিদেশি সহায়তাকারীদের প্রবেশের অনুমতি দেননি। এমনকি এই ভয়াবহ সময়েও আগের মতোই তিনি সামরিক খাতে বরাদ্দ অব্যাহত রেখেছিলেন।
২০০৮ সালে প্রথমবার হূদরোগে আক্রান্ত হন কিম জং ইল। এরপর তাঁকে তেমনভাবে জনসম্মুখে দেখা যায়নি। কিমের তিন ছেলে রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, ছোট ছেলে কিম জং উনকেই তিনি তাঁর উত্তরসূরি নির্বাচন করে গেছেন। আল জাজিরা টেলিভিশনের অনলাইন অবলম্বনে।
সূত্র: প্রথমআলো.কম, ১৯/১২/২০১১
No comments:
Post a Comment