রক্তে ধীরগতিতে শর্করা মুক্ত করে এমন চাল বাজারজাত করা শুরু করেছে একটি বেসরকারি কোম্পানি।
আর বিশেষ এই ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনিস্টিটিউটের (বিআরআরআই)
বিজ্ঞানীরা। চিকিৎসকরা বলছেন, এই ধান উদ্ধাবনের ফলে ডায়াবেটিস রোগীদের আর ভাত খাওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভুগতে হবে না। তবে নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপনের বিষয়টিও মনে করে দিয়েছেন তারা। জীবনযাত্রার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশেও ডায়াবেটিস রোগ এখন ঘরে ঘরে। আর ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলে শর্করাসমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ কমিয়ে দিতে হয়, যদিও এ দেশের মানুষের প্রধান খাবার ভাতও একটি শর্করাসমৃদ্ধ খাবার। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনিস্টিটিউটের উদ্ভাবিত বিভিন্ন জাতের চালে শর্করার পরিমাণ নির্ণয় করে একটি ‘লো গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (জিআই)’ তৈরি করেছে ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান রেনাটা লিমিটেডের অধীনে রেনাটা অ্যাগ্রো ইডাস্ট্রিজ লিমিটেড। রক্তে শর্করা ভেঙে গ্লুকোজে পরিণত হওয়ার গাণিতিক হারই হলো গ্লাইসেমিক ইনডেক্স। রেনাটা লিমিটেডের আরেক প্রতিষ্ঠান পূর্ণাভা লিমিটেড সম্প্রতি ‘পূর্ণ লো জিআই রাইস’ নামে এক ধরনের চাল বাজারজাত করতে শুরু করেছেন, যা রক্তে ধীরগতিতে শর্করা মুক্ত করে।
বৃহস্পতিবার আনুষ্ঠানিকভাবে এ চাল বাজারজাত করার ঘোষণা দেওয়ার পরে স্বাস্থ্যমন্ত্রী আফম রুহুল হক বলেন, বাংলাদেশে বৈজ্ঞানিক গবেষণার ক্ষেত্রে এটি বিশাল এক অর্জন। রাজধানী বারডেম মিলনায়তনে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে যারা ভাত পছন্দ করেন কিন্তু খেতে পারেন না, তাদের জন্য আনন্দের খবর নিয়ে এসেছে এ চাল। ধান গবেষণা ইনিস্টিটিউটের গ্রেইন কোয়ালিটি অ্যান্ড নিউট্রিশন বিভাগের প্রধান মুহম্মদ আলী সিদ্দিক জানান, তাদের সরাসরি তত্ত্বাবধানেই এ ধান উদ্ভাবিত হয়েছে।
“এ চালে আঁশের পরিমাণও তুলনামূলকভাবে বেশি, কারণ পরামর্শ অনুযায়ী এ জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে।”
ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য বিশেষায়িত বারডেম হাসপাতালের রোগীদের ওপর ইতোমধ্যে ‘লো জিআই’ চালের প্রভাব পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে বলেও অনুষ্ঠানে জানানো হয়। এ গবেষণা দলের প্রধান ও বারডেম ল্যাবরেটরির পরিচালক ডা. শুভাগত চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা দেখেছি, এ চাল রক্তে শর্করার পরিমাণকে একটি নিরাপদ পর্যায়ে ধরে রাখে, যা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য খুবই উপযোগী।” এই চালের ভাত খেলেও ডায়াবেটিস রোগীদের নির্দিষ্ট নিয়ম ও খাদ্য তালিকা মেনে চলতে হবে বলে সতর্ক করে দেন তিনি।
ডা. শুভাগত বলেন, “ভাত অতিভোজনের জন্য নয়। ডায়াবেটিস রোগীদের নিয়মিত নির্দিষ্ট পরিমাণ খাবার গ্রহণ করতে হবে।” “ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য এক কাপ ভাত আর তিন কাপ সবজিতেই এক বেলার পূর্ণ আহার হয়”, বলেন তিনি।
অবশ্য চাল নিয়ে এই গবেষণাটি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে বলে এই বিশেষজ্ঞ জানান।
ডা. শুভাগত বলেন, লো জিআই খাদ্য ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ার মতো উন্নত দেশগুলোতে খুবই সাধারণ ব্যাপার। তবে বাংলাদেশে এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর আগে আরো অনেক কিছু করতে হবে।
১৯৮০ সালে ইউনিভার্সিটি অব টরোন্টোর গবেষক ডা. ডেভিড এ. জেনকিনস সর্বপ্রথম জিআইর গাণিতিক হিসাব প্রবর্তন করেন। ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য শর্করাযুক্ত কোন খাবারটি সবচেয়ে বেশি উপযোগী তা খোঁজার চেষ্টা করেন তিনি।
জিআই অনুযায়ী ০ থেকে ১০০ মাত্রার মধ্যে শর্করা ভেঙে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বাড়ার হার নির্দেশ করা হয়। ৭০ এর ওপরে উচ্চ জিআই, ৫৯ থেকে ৬৯ পর্যন্ত মধ্যম জিআই এবং ৫৫ এর নিচে নিু জিআই ধরে নেওয়া হয়।
অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরী বলেন, কোনো নির্দিষ্ট শর্করাযুক্ত খাবার ভেঙে কতো দ্রুত গ্লুকোজে পরিণত হয়, জিআই দিয়ে সেটাই শুধু জানা যায়। ওই খাবারের মাধ্যমে কতোখানি শর্করা গ্রহণ করা হচ্ছে- তা জানা যায় না। এ জন্য গ্লাইসেমিক লোডের হিসাব দরকার হয়।
শর্করাযুক্ত কোনো কোনো খাবার খুব দ্রুত, আবার কোনো কোনো খাবার খুব ধীরে হারে গ্লুকোজে পরিণত হয়ে থাকে। দ্বিতীয় ধরনের খাবারই ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য উপযোগী বলে জানান শুভাগত চৌধুরী।
তিনি বলেন, মানুষের রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ স্থিতিশীল থাকলে দেহ সবচেয়ে ভালোভাবে কাজ করে। এর পরিমাণ বেশি কমে গেলে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে, ক্ষুধা বেড়ে যায়। আর বেশি বেড়ে গেলে অগ্নাশয়কে ইনসুলিন তৈরির নির্দেশ পাঠাতে থাকে মস্তিষ্ক।
রেনেটা অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, লো জিআই চালের দাম পড়বে প্রতি কেজি ১০০ টাকা। বিভিন্ন সুপার স্টোর ও ওষুধের দোকানে এটি পাওয়া যাবে।
সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতায় নিয়ে আসার জন্য এ চালের দাম আরো কমানোর আহ্বান জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী। তিনি দেশের বাইরে এ চাল রপ্তানিরও পরামর্শ দেন।
বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি হিসাব অনুযায়ী, এ দেশে প্রায় ৭০ লাখ মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
No comments:
Post a Comment