পাকিস্তানি সেনা-বাহিনীর নির্মম নৃশংসতার রক্তাক্ত বিবরণ ঢাকা থেকে ওয়াশিংটনে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টে পাঠিয়ে যাচ্ছেন ঢাকায় কর্মরত কনসাল জেনারেল আর্চার ব্লাড। কিন্তু তা কোনোভাবেই নিক্সন প্রশাসনকে পাকিস্তান-বান্ধব অবস্থান থেকে সরিয়ে আনতে পারছে না। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার প্রকারান্তরে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সংহতির জন্য সহিংসতাকে সমর্থন করে যাচ্ছেন, পূর্ব পাকিস্তানে ব্যবহারের জন্য মার্কিন বন্দর থেকে জাহাজে ওঠানো হচ্ছে অস্ত্র ও রসদ—একজন এডওয়ার্ড কেনেডি দাঁড়িয়ে গেলেন নিপীড়িত বাংলাদেশের পক্ষে। তাঁকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের এবং সামগ্রিকভাবে
পশ্চিমের বিবেক জেগে উঠল। মার্কিন সহায়তায় পাকিস্তানের সামরিক সরকার মানবতা ও গণতন্ত্রের মানচিত্র ধূলিসা ৎ করে দিচ্ছে, ডেমোক্র্যাট সিনেটর কেনেডি শুরু থেকে এর বিরুদ্ধে সোচ্চার।কেনেডি ১৯৬২ থেকে সিনেটর। ১৯৭১-এ তাঁর বয়স ৩৯, তখন তিনি শরণার্থীবিষয়ক সিনেট জুডিশিয়ারি উপকমিটির চেয়ারম্যান। ১৯৭১-এর আগস্টে তিনি এলেন বাংলার মানুষের দুর্দশার সাক্ষী হতে, নিজ চোখে দেখে বিশ্ববিবেক জাগাতে। তিনি কলকাতা, জলপাইগুড়ি, ত্রিপুরা ও দার্জিলিংয়ের শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করলেন এবং লিখলেন: পূর্ব বাংলার ট্র্যাজেডি কেবল পাকিস্তানের জন্য ট্র্যাজেডি নয়, এটা কেবল ভারতের জন্য ট্র্যাজেডি নয়, এটা সমগ্র বিশ্ব সম্প্রদায়ের জন্য ট্র্যাজেডি এবং এই সংকট নিরসনের জন্য একত্রে কাজ করা বিশ্ব সম্প্রদায়েরই দায়িত্ব। শরণার্থী শিবিরে ভাগ্যাহত বিপন্ন মানুষের অবস্থা দেখে তিনি যে মন্তব্য করেছেন, তা উদ্ধৃত করে লন্ডন টাইমস লিখেছে, এটা মানবজাতির জন্য আমাদের সময়ের সম্ভবত সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি।
এডওয়ার্ড কেনেডি প্রশ্ন রেখেছেন, ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে বাঙালিদের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভই যদি অপরাধ হয়ে থাকে, তাহলে গণতন্ত্রের ভবিষ্য ৎ কী? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের প্রতি সমর্থন কি তাহলে প্রহসন হয়ে যায় না? কেনেডি শরণার্থী শিবির ঘুরে স্বদেশে ফিরে একই সঙ্গে মানবতার লাঞ্ছনা এবং একটি দেশের সম্ভাব্য অভ্যুদয়ের চিত্র তুলে ধরেছেন: এই কঠিন ট্র্যাজেডি পৃথিবী এখনো বুঝে উঠতে পারেনি। আমি আপনাদের বলতে পারি, যতক্ষণ না নিজ চোখে দেখছেন, এর বিশাল ব্যাপ্তি সম্পর্কে ধারণাও করতে পারবেন না। কেবল সেখানে গেলেই সেখানকার অনুভূতি আপনি আঁচ করতে পারবেন, মানুষের ভোগান্তি বুঝতে পারবেন, সহিংসতার যে শক্তি শরণার্থীর জন্ম দিচ্ছে এবং বেসামরিক মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা বাড়িয়ে যাচ্ছে, তা অনুধাবন করতে পারবেন।
শরণার্থী শিবির ঘুরে যখন তিনি খুলনা সীমান্তে, সেদিন কমপক্ষে সাত হাজার শরণার্থী বয়রার কাছে নদী পেরিয়ে সীমান্ত ঘেঁষে স্রোতধারার মতো নেমে এসেছে। এদের প্রায় সবাই কৃষক, চাষি-মজুর, অধিকাংশই হিন্দু। ঢাকা জেলার দক্ষিণে খুলনা ও বরিশাল থেকে এসেছে। গত শরতের সাইক্লোনে বিধ্বস্ত প্রান্তবর্তী জেলা থেকে। (ষাটজনের সাক্ষ্য থেকে উদ্ধৃত)
১ নভেম্বর ১৯৭১ মূলত পূর্ব বাংলার সংকট নিরসনের জন্য কেনেডি যে সাত দফা সুপারিশ পেশ করেন, তার একটি ছিল: ‘ইসলামাবাদ সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক শক্তিগুলোর প্রতীকী নেতৃত্ব শেখ মুজিবের। এই সংকটের যেকোনো রাজনৈতিক সমাধানে তাঁর প্রতি ন্যায়বিচার এবং তাঁর ব্যক্তিগত নিরাপত্তার গুরুত্ব সর্বাধিক।’ সাত দফার একটি: দক্ষিণ এশিয়ার সংকটের মূল কারণ যুক্তরাষ্ট্রকে খতিয়ে দেখতে হবে; অপর একটি: পূর্ব বাংলা ট্র্যাজেডি অবশ্যই জাতিসংঘের সামনে উপস্থাপন করতে হবে এবং সাধারণ পরিষদের বিশেষ কমিটিতে অন্তর্ভুক্তির চলমান প্রচেষ্টায় যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন করতে হবে।
সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২-এর ফেব্রুয়ারি মাসে কেনেডি যখন সফরে এলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবন চত্বরে তাঁকে নিয়ে ‘জয় কেনেডি জয় কেনেডি’ আনন্দধ্বনি উঠেছিল। দুঃসময়ের এই বন্ধুকে দিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে উ ৎপাটিত বটমূলে নতুন করে বটবৃক্ষের চারা রোপণ করানো হয়েছিল। তখন স্কুলছাত্র হলেও পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে মাথা উঁচিয়ে এই বৃক্ষরোপণের দৃশ্যটি দেখার সুযোগ নিবন্ধকারের হয়েছিল। এডওয়ার্ড কেনেডির সঙ্গে এসেছিলেন তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রী কেরোলিন কেনেডি। বিস্মিত চোখে তিনিও দেখছিলেন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে দুঃসময়ের বন্ধুকে নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের প্রবল উচ্ছ্বাস। দেশে ফিরেই তিনি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য তাঁর ওজনদার ক্রমাগত চাপ অব্যাহত রাখলেন, শরণার্থী পুনর্বাসনে আন্তর্জাতিক সহায়তা চাইলেন, পিএল ৪৮০-এর আওতায় খাদ্য-সহায়তা কর্মসূচি দ্রুত চালুর দাবি জানালেন।
‘গণতন্ত্রের আইকন’, ‘সিনেটের সিংহ’ এডওয়ার্ড মুর কেনেডির জন্ম ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৩২, মৃত্যু ২৫ আগস্ট ২০০৯।
তিনি দীর্ঘ ৪৭ বছর ম্যাসাচুসেটস থেকে নির্বাচিত সিনেটর ছিলেন। আততায়ীর হাতে প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি এবং পরবর্তী সময়ে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী রবার্ট কেনেডি নিহত হওয়ার পর প্রেসিডেন্ট পদে তাঁর প্রার্থিতাই যখন ছিল সবচেয়ে অনুকূল; একটি ব্যক্তিগত দুর্ঘটনা ও পারিবারিক প্রয়োজন তাঁকে এই সম্ভাবনা থেকে সরিয়ে রাখে। তাঁর উদ্যোগ এবং তাঁর সহায়তায় ৪৭ বছরে যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৩০০ জনকল্যাণমুখী ও শান্তি-সহায়ক আইন পাস হয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪০ বছর পূর্তিতে এই অকৃত্রিম বন্ধুর প্রতি অশেষ শ্রদ্ধা।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪০ বছর পূর্তিতে এই অকৃত্রিম বন্ধুর প্রতি অশেষ শ্রদ্ধা।
সূত্র: প্রথমআলো. কম, 0৩/১২/২০১১
No comments:
Post a Comment