মাগুরার মোহাম্মদপুরের একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক নগেন্দ্রনাথ বিশ্বাস দেড় বছর আগে পেনশনের আবেদন করেন। কিন্তু এখনো তাঁর পেনশনের দেখা নেই। তিনি বলেন, 'চাকরি শেষে দুইবার স্ট্রোক হয়েছে। এ অবস্থায় তদবির করতে পাবলিক গাড়িতে যেতে পারি না। ৫০ টাকা বেতনে চাকরিতে ঢুকেছিলাম। এখন আমার কত ছাত্র বড় বড় জায়গায় চাকরি করে। কিন্তু তারা কি জানে, তাদের স্যার আজ কত অসহায়?'
অবসরে যাওয়া শিক্ষকরা বলছেন, মোটা দিস্তার জীবনপঞ্জি নিয়ে দপ্তরের একাধিক দরজায় ঘুরে ঘুরে তাঁদের জুতাও ছিঁড়ে যায়। অনেককে পেনশনের টাকা পাওয়ার আগেই বিদায় নিতে হয় পৃথিবী থেকে।
বেশির ভাগ শিক্ষকই গরিব, অবসরে গিয়ে উপার্জনহীন অবস্থায় তাঁদের হাড়কঙ্কাল চেহারা ফুটে ওঠে। যে হাতে তাঁরা শিক্ষা বিলিয়েছেন বছরের পর বছর, সেই হাতে শেষমেশ পেনশন পাওয়ার জন্য ঘুষও ধরিয়ে দেন ছাত্রসম কর্মকর্তা-কর্মচারীদের।
শিক্ষকদের পেনশন প্রাপ্তির বাধাবিপত্তি দূর করার, নিয়মাবলি সহজ করার চিন্তাভাবনা চলছে বলে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। কিন্তু এ চিন্তাভাবনা এখনো বাস্তবরূপ পায়নি। কিভাবে সহজ করা হবে তা বলেননি তিনি। তাঁর ভাবনা সংশ্লিষ্ট দপ্তরও জানে না। তারা বরং বলছে, মূলত টাকার (ফান্ড) অভাবে সময়মতো পেনশন দেওয়া যাচ্ছে না।
৫৭ বছর শেষে শিক্ষকরা অবসরে যান। সরকারি শিক্ষকরা অবসরের পর এক বছর অবসরকালীন ছুটিতে থাকেন। এরপর তাঁরা পেনশন সুবিধার জন্য আবেদন করেন। শিক্ষকরা বলছেন, আবেদনের সঙ্গে প্রথমেই পাঁচ থেকে ১০ হাজার টাকা দিতে হয় সংশ্লিষ্ট অফিস সহকারীকে। এই টাকা না দিলে আবেদন থেকে কাগজগুলো হারিয়ে যেতে থাকে।
সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে কাগজ চূড়ান্ত হয়ে যায় হিসাবরক্ষণ অফিসে। সেখানে 'সেলামি' না দিলে কাগজ গায়েব হয়ে যায়। আর বেসরকারি শিক্ষকরা চাকরি থেকে অবসরের পরেই কল্যাণ তহবিল ও অবসর বোর্ডে আবেদন করেন। সেখানে দিনের পর দিন আবেদন পড়ে থাকে। রাজধানীর পলাশীতে ব্যানবেইস ভবনের নিচ তলার একপাশে রয়েছে তাঁদের জন্য অবসর বোর্ড, অন্য পাশে কল্যাণ বোর্ডের অফিস। এ দুটি অফিসে শিক্ষকদের পেনশন আবেদন ফাইলবন্দি হয়ে পড়ে আছে। কর্মকর্তারা বলছেন, ২০১০ সালের আগস্ট পর্যন্ত তাঁদের কল্যাণ বোর্ডের এবং একই বছরের জুন পর্যন্ত অবসর বোর্ডের টাকা দেওয়া হয়েছে। এরপর টাকার অভাবে চলতি মাস পর্যন্ত অবসরে যাওয়া বেসরকারি শিক্ষকদের আবেদনের নিষ্পত্তি করা যাচ্ছে না।
বেসরকারি শিক্ষকদের পেনশন : গত ১ নভেম্বর অবসর বোর্ডে গিয়ে দেখা যায়, শিক্ষক ও তাঁদের প্রতিনিধিদের ভিড়। সবাই খোঁজ নিতে এসেছেন তাঁদের আবেদনটির কী হলো? মাগুরার নগেন্দ্রনাথ বিশ্বাসকে দেখা গেল ছোটাছুটি করছেন। লালমনিরহাটের সাপ্টীবাড়ী দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন ফজলুর রহমান। ২০০৯ সালে অবসর নেওয়ার পর অবসর সুবিধা পাওয়ার জন্য আবেদন করেন। তাঁর ছেলে স্বপন মিয়া এসেছেন বাবার আবেদনের সর্বশেষ খবর জানতে। অফিসের কর্তারা তাঁকে জানিয়েছেন, তাঁর বাবার ফাইল অনুমোদন হয়ে গেছে। কিন্তু কত মাস পর টাকা পাওয়া যাবে তা বলেননি। হবিগঞ্জের মিরপুর এফএন হাই স্কুলের ধর্মীয় শিক্ষক রবীন্দ্র চক্রবর্তী গত বছরের অক্টোবরে পেনশনের জন্য আবেদন করেন। তদবির করতে করতে এক বছর পরে এসে তিনি শুধু কল্যাণ সুবিধার 'চেক'
পেয়েছেন। অবসর সুবিধা বোর্ডের চেকের খোঁজ নিতে এ নিয়ে তিনি বোর্ড অফিসে কয়েকবার এসেছেন বলে এ প্রতিনিধিকে জানান।
নেত্রকোনা জেলার নোয়াগাঁও আফতাব হোসেন একাডেমীর সিনিয়র সহকারী শিক্ষক সুখরঞ্জন অবসর ভাতার জন্য আবেদন করেছেন ২০০৯ সালের ৬ আগস্ট। আজ পর্যন্ত তাঁর আবেদনটি মঞ্জুর হয়নি। প্রায় দেড় বছর পর তাঁকে জানানো হয়, তাঁর নামের বানানে ভুল রয়েছে। এটি ঠিক করা ছাড়া অবসর ভাতা দেওয়া সম্ভব নয়। পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জের শামীম আহমেদ তাঁর বাবার অবসর ভাতার জন্য ঘুরছেন প্রায় এক বছর ধরে। অবসর বোর্ডে তাঁর সঙ্গে দেখা হয় ব্যানবেইসের নিচ তলায়। শামীম বলেন, 'এ পর্যন্ত কমপক্ষে ১৫ দিন আমি পটুয়াখালী থেকে ঢাকা এসেছি। নানাভাবে আমাকে হয়রানি করা হচ্ছে।'
পটুয়াখালী বাউফল উপজেলার উত্তর কর্পূরকাঠি ইদ্রিসিয়া দাখিল মাদ্রাসার সুপারিনটেনডেন্ট মাওলানা হারুন-অর-রশিদ ২০০৪ সালে লিভার ক্যান্সারে মারা যান। ২০০৬ সালে অবসর ভাতার জন্য তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে আবেদন করা হয়। দীর্ঘদিন ধরে তাঁর ফাইলটি আটকে থাকে। 'এই কাগজ নেই, সেই কাগজ নেই' বলে পরিবারটিকে ঘোরানো হয়। তারপর একদিন বলা হয়, অবসর ভাতা দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ হারুন-অর-রশিদের চাকরির বয়স ১১ বছর হয়নি।
অবসর সুবিধা বোর্ডের বিরুদ্ধে ঘুষ-বাণিজ্যের অভিযোগ বিস্তর। সম্প্রতি সোনারগাঁওয়ের একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক অবসর ভাতার আবেদনের সঙ্গে পাঁচ হাজার টাকা ধরিয়ে দেন। বিষয়টি স্বীকার করেছেন অবসর বোর্ডের সদস্যসচিব অধ্যাপক আসাদুল হক। তিনি অবশ্য বলেছেন, 'মানুষের মনে একটা ধারণা আছে, টাকা না দিলে কাজ হয় না। এ জন্যই এমনটা হচ্ছে।'
আসাদুল হক বলেন, 'সোনারগাঁওয়ের এক স্কুল শিক্ষক আবেদনের সঙ্গে পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছিলেন এ কথা সত্য। আমরা পরে তাঁকে খুঁজেও পাইনি। আগে এ ধরনের কর্মকাণ্ড বেশি হতো। এখন অনেক কমে গেছে। পেনশন মানেই ভোগান্তি_এই কথা এখনো প্রচলিত আছে। তবে ভবিষ্যতে এটা থাকবে না, সে লক্ষ্যে কাজ করছি।'
অবসর বোর্ড সূত্র জানায়, এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রায় পাঁচ লাখ শিক্ষক-কর্মকর্তার অবসরভাগ্য ঝুলে আছে। অবসর সুবিধা বোর্ড এ বাবদ বর্তমান সরকারের কাছে ৬০০ কোটি টাকা চেয়েছিল। একাধিকবার প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেলেও টাকা এখনো পাওয়া যায়নি। নতুন বেতন স্কেল অনুযায়ী জুলাই থেকে প্রতি মাসে অবসর সুবিধার জন্য দরকার হবে কমপক্ষে ৬০ কোটি টাকা। এর মধ্যে শিক্ষক-কর্মকর্তাদের চাঁদার টাকা থেকে পাওয়া যাবে প্রায় ১৬ কোটি টাকা। প্রতি মাসে আরো দরকার হবে ৪৪ কোটি টাকা। তা না পেলে অবসর ভাতার জন্য মাসের পর মাস ঘুরতে হবে আবেদনকারীদের।
অবসর বোর্ডে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় ১৬ হাজার আবেদন পড়ে আছে। প্রতিদিনই ছয় শ থেকে সাত শ আবেদন পড়ছে। সারা দেশে মোট ২৬ হাজার ৬০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এ প্রকল্পের অধীন।
শিক্ষকদের অবসর ভাতার জন্য বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের ১০০ কোটি টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুত ছিল। কিন্তু তিন ধাপে দেওয়া হয়েছিল ৮৯ কোটি টাকা। তবে সঙ্গে শর্ত ছিল, ৮৯ কোটি টাকা খরচ করা যাবে না। এর লাভ থেকে প্রয়োজনীয় খাতে ব্যয় করা যাবে।
অবসর বোর্ডের সচিব আসাদুল হক বলেন, 'আমরা মহা অর্থসঙ্কটে আছি। বর্তমান সরকারকে ৬০০ কোটি টাকা দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছি। কবে এ টাকা পাব জানি না। আগামী মাস থেকে ৬০ কোটি টাকা প্রয়োজন হবে। চাঁদা থেকে পাব ১৬ কোটি টাকা। বাকি ৪৪ কোটি টাকা কোথা থেকে আসবে তা নিয়ে আমাদের চিন্তার অন্ত নেই।'
কল্যাণ বোর্ডের সদস্যসচিব অধ্যক্ষ শাহজাহান সাজু বলেন, ২০১০ সালের আগস্ট পর্যন্ত শিক্ষকদের কল্যাণ ট্রাস্টের পাওনা মেটানো হয়েছে। একই বছরের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে যেসব শিক্ষক অবসর নিয়েছেন এখন তাঁদের পেনশন দেওয়ার কাজ চলছে। তিনি বলেন, ২০১২ সালে শিক্ষকদের অবসর নেওয়ার চাপ থাকবে। যেসব শিক্ষক সত্তরের দশকে চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন, তাঁরা সবাই আগামী বছর অবসর নেবেন। এরপর থেকে চাপ কমবে। তিনি বলেন, সরকারের কল্যাণ ট্রাস্টের টাকা ২০১২ সাল পর্যন্ত আপডেট করতে ৪১২ কোটি টাকা প্রয়োজন। কিন্তু ফান্ডে প্রয়োজনীয় টাকা নেই।
সরকারি শিক্ষকদের পেনশন : সরকারি কলেজের শিক্ষকদের পেনশনের আবেদন করতে হয় মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরে (মাউশি)।
সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আবেদন করতে হয় মাধ্যমিক শিক্ষার আঞ্চলিক উপপরিচালকদের কার্যালয়ে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আবেদন করতে হয় উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে। তিন স্তরের শিক্ষকরা পৃথক তিনটি কার্যালয়ে আবেদন করলেও তাঁদের ভোগান্তির ধরন প্রায় একই।
মাউশির প্রশাসন শাখা জানায়, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক পেনশনের আবেদনটি প্রথমে মাউশির অডিট শাখায় পাঠানো হয়। ২১ দিনের মধ্যে অডিট শেষ করে তা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট বিভাগের উপসচিব ড. খালিদ হোসেন পরের প্রক্রিয়া সম্পর্কে কালের কণ্ঠকে বলেন, মন্ত্রণালয় এক সপ্তাহের মধ্যে পেনশনের কাজ শেষ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের হিসাবরক্ষণ অফিস ৪৫ পুরানা পল্টনে পাঠিয়ে দেয়। মন্ত্রণালয়ে পেনশনের আবেদন জমা থাকে না। আবেদন আসা মাত্র কাজ শেষ করে দেওয়া হয়।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মায়সুর মাহমুদ চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, হিসাবরক্ষণ অফিসেও পেনশনের আবেদন জমা থাকে না। কেন্দ্রীয় হিসাবরক্ষণ অফিসের নির্দেশে পেনশনের আবেদনের নিষ্পত্তি করে অর্থ পাঠানোর বিষয়টি ১০ দিনের মধ্যে শেষ করতে হয় এবং তা প্রতি মাসে কেন্দ্রীয় হিসাবরক্ষণ অফিসে জমা দিতে হয়।
তাঁদের প্রত্যেকেরই দাবি, পেনশন নিয়ে কোনো ভোগান্তি নেই। তবে তাঁরা এটাও বলেছেন, কোনো শিক্ষকের পেনশনের আবেদনে ভুল বা সার্ভিস বুক ঠিক না থাকলে একটু ঝামেলা হয়। সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই ঝামেলা 'একটু' নয়, বেশ বেশি এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তা তৈরি করেন।
হিসাবরক্ষণ অফিসের নথি থেকে দেখা গেছে, গত জুলাই মাসে ২২ জনের পেনশন কেস নিষ্পত্তি করা হয়েছে। কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে এই ২২টির মধ্যে ১৮টি আবেদন হিসাবরক্ষণ অফিসে এসে পেঁৗছাতে সময় লেগেছে তিন মাস। দুটি আবেদন ছয় মাস এবং বাকি দুটি আবেদন আসতে সময় লেগেছে ১৮ মাস। পরের মাস আগস্টে ১৩টি আবেদন নিষ্পত্তি করা হয়েছে। নথিতে দেখা গেছে, এর মধ্যে ১০টি আবেদন হিসাবরক্ষণ অফিসে পেঁৗছাতে সময় লেগেছে ১০ মাস, একটি আবেদন এসেছে ছয় মাসে, এক বছরে এসেছে একটি এবং ১৮ মাসে এসেছে একটি। আর গত সেপ্টেম্বরে ২০টি আবেদন নিষ্পত্তি করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৬টি এসেছে তিন মাসের মধ্যে, ছয় মাসের মধ্যে এসেছে দুটি, এক বছরের মধ্যে এসেছে একটি এবং ১৮ মাসের মধ্যে এসেছে একটি আবেদন।
হিসাবরক্ষণ অফিসের অডিটর জামাল উদ্দিন এ প্রসঙ্গে কালের কণ্ঠকে বলেন, যে শিক্ষক যে তারিখে আবেদন করেছেন, সেই তারিখ থেকে আবেদন হিসাবরক্ষণ অফিসে আসতে যে সময় লেগেছে শুধু তারই ব্যাখা দেওয়া হয়েছে এই পরিসংখ্যানে। তিনি দাবি করেন, হিসাবরক্ষণ অফিসে আসার পর ১০ দিনের মধ্যে প্রতিটি আবেদন নিষ্পত্তি করা হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক কালের কণ্ঠকে জানান, হিসাবরক্ষণ অফিসের এ পরিসংখ্যান থেকেই বোঝা যায় শিক্ষকদের পেনশন প্রাপ্তিতে কত ভোগান্তি হয়।
২০০৯ সালে পেনশনের জন্য অবেদন করেছিলেন অধ্যাপক ইয়াসমিন বানু। আবেদনটি চূড়ান্ত যাচাই-বাছাই শেষে সব দপ্তর পেরিয়ে হিসাবরক্ষণ অফিসে পেঁৗছে চলতি বছরের ৩ মে। হিসাবরক্ষণ অফিস আবেদনটি বিশ্লেষণ করে গত ১৫ মে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়ে জানায়, পেনশন ফরমের ৬ নম্বর পৃষ্ঠায় ৫ দশমিক ৩ অনুচ্ছেদে মঞ্জুরিকারী কর্তৃপক্ষের সিল নেই। আবেদনের সংযোজনী ৮-এর না দাবিপত্রে দপ্তরপ্রধানের সই নেই। ইএলপিসি এবং চাকরির বিবরণীর মূল কপিতে সংযোজন নেই। এ অবস্থায় পেনশন কেসটি নিষ্পত্তি করা যাচ্ছে না।
একইভাবে গত ১৪ জুলাই রাজধানীর কবি নজরুল কলেজ থেকে অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক মুহাম্মদ আবদুল খালেক মিয়া, ৩১ জুলাই রাজধানীর সরকারি তিতুমীর কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক বেগম সাঈদা আক্তার এবং ২৭ অক্টোবর সহকারী অধ্যাপক মো. আনোয়ার হোসেনের পেনশন আবেদনে বিভিন্ন অসংগতি থাকার কথা উল্লেখ করে উল্লেখিত তারিখে হিসাবরক্ষণ অফিস চিঠি দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে। কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয় এখন পর্যন্ত চিঠির জবাব না দেওয়ায় এসব আবেদনের নিষ্পত্তি হচ্ছে না।
ভুক্তভোগী শিক্ষকরা বলছেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শাখা ৬ ইচ্ছে করে এসব আবেদনে ত্রুটি বের করে রাখে। শিক্ষকরা ঠিকমতো কাগজ জমা দিলেও ওই শাখার প্রশাসনিক কর্মকর্তারা তা সরিয়ে ফেলেন। এরপর ওই ত্রুটিযুক্ত আবেদনই হিসাবরক্ষণ অফিসে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
রাজধানীর বিখ্যাত একটি কলেজ থেকে অবসর নেওয়া এক অধ্যাপক ২০০৯ সালে পেনশনের আবেদন করেন। ২০১১ সালে এসেও তাঁর কাজ শেষ হয়নি। দিনের পর দিন এটা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শাখা ৬-এ পড়ে থাকে। তিনি বলেন, একপর্যায়ে আমি ১০ হাজার টাকা দেওয়ার পর আমার ফাইল নড়াচড়া শুরু করে।
শাখা ৬-এর প্রশাসনিক কর্মকর্তা আবদুল মাবুদ মণ্ডল অভিযোগ অস্বীকার করে কালের কণ্ঠকে বলেন, এগুলো মিথ্যা কথা। এখানে আবেদন আসার সঙ্গে সঙ্গে ওপরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এ শাখা থেকে শিক্ষকদের কোনো ভোগান্তিই পেতে হয় না।
মাউশির উপপরিচালক (প্রশাসন) ড. জাহাঙ্গীর হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের আবেদনে কোনো ঝামেলা থাকলেও তা নিরসন করে ২১ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।
অসাধু কর্মকর্তাদের চালিয়াতি ছাড়াও বাস্তবিক কারণেও শিক্ষকদের কাগজপত্র নিয়ে ঝামেলা পোহাতে হয়। শিক্ষকরা যেখানে-যেখানে চাকরি করেন সেখানকার রেকর্ড রাখতে হয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকেই। কিন্তু কর্তৃপক্ষ এ রেকর্ড রাখে না। আর শিক্ষকরাও তা খেয়াল করেন না। চাকরির শেষে যখন পেনশন নেওয়ার সময় আসে তখন এসব বেরিয়ে আসে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পেনশন ভোগান্তি থেকে শিক্ষকদের রেহাই পেতে চাকরি জীবনের রেকর্ড রাখার জন্য ডিজিটাল পদ্ধতির ব্যবহার শুরু হয়েছে। মাউশির কম্পিউটার সেলের শিক্ষকদের এ রেকর্ড রাখার কথা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেখানেও তা ঠিকমতো রাখা হয় না।
এ বিষয়ে মাউশির পরিচালক (মাধ্যমিক) অধ্যাপক মো. শফিকুর রহমান নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, 'আমি পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) ছিলাম। সেখান থেকে বদলি হয়ে ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজের অধ্যক্ষ হই। অধ্যক্ষ হওয়ার আদেশ কম্পিউটার সেলে জমা দিই। আমি তো ভেবেছি ওই ফাইলে আমার নাম লেখা রয়েছে। আমি আর খোঁজ নিইনি। পরে অধ্যক্ষ পদ থেকে বদলি হয়ে মাউশির পরিচালক পদে যোগ দিই। যথারীতি কাগজ জমা দিয়েছি। কিন্তু আমার কর্মস্থল আর আপডেট হয়নি।' তিনি বলেন, "সম্প্রতি মাউশিতে এসব বিষয় নিয়ে একটি কর্মশালায় আমি আমার রেকর্ড দেখানোর অনুরোধ জানাই। সেখানে দেখি আমার বিষয়ে লেখা রয়েছে_ 'অধ্যাপক শফিকুর রহমান, সদস্য (পাঠ্যপুস্তক)।' অথচ ওই সদস্যপদ থেকে বদলি হয়ে আরো দুটি পদে এসেছি। কিন্তু আমার কর্মস্থল আর রেকর্ডে পরিবর্তন হয়নি। এই পরিবর্তন না হওয়াটাই পেনশনের সময় বড় হয়ে দেখা দেয়। আর ভোগান্তির শুরু হয়।"
শফিকুর রহমান বলেন, 'আমি দেখেছি বলে আমার বিষয়টি পরিবর্তন করতে পেরেছি। প্রত্যন্ত এলাকার একটি কলেজের শিক্ষক তো আর নিজে দেখতে পাচ্ছেন না। তাঁর রেকর্ড আপডেট হচ্ছে কি না, তা হয়তো তিনি জানছেন না।'
পেনশন নিয়ে ভুক্তভোগী এক শিক্ষকের (মৃত) সন্তান সাজিদুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, বর্তমানে যেভাবে পেনশন তুলতে হয় তাতে সব 'লস' হয়। তিনি এ পদ্ধতিকে সত্যিকারের ডিজিটালে রূপান্তরের দাবি জানান।
সূত্র: কালেরকণ্ঠ, ০৯/১২/২০১১
অবসরে যাওয়া শিক্ষকরা বলছেন, মোটা দিস্তার জীবনপঞ্জি নিয়ে দপ্তরের একাধিক দরজায় ঘুরে ঘুরে তাঁদের জুতাও ছিঁড়ে যায়। অনেককে পেনশনের টাকা পাওয়ার আগেই বিদায় নিতে হয় পৃথিবী থেকে।
বেশির ভাগ শিক্ষকই গরিব, অবসরে গিয়ে উপার্জনহীন অবস্থায় তাঁদের হাড়কঙ্কাল চেহারা ফুটে ওঠে। যে হাতে তাঁরা শিক্ষা বিলিয়েছেন বছরের পর বছর, সেই হাতে শেষমেশ পেনশন পাওয়ার জন্য ঘুষও ধরিয়ে দেন ছাত্রসম কর্মকর্তা-কর্মচারীদের।
শিক্ষকদের পেনশন প্রাপ্তির বাধাবিপত্তি দূর করার, নিয়মাবলি সহজ করার চিন্তাভাবনা চলছে বলে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। কিন্তু এ চিন্তাভাবনা এখনো বাস্তবরূপ পায়নি। কিভাবে সহজ করা হবে তা বলেননি তিনি। তাঁর ভাবনা সংশ্লিষ্ট দপ্তরও জানে না। তারা বরং বলছে, মূলত টাকার (ফান্ড) অভাবে সময়মতো পেনশন দেওয়া যাচ্ছে না।
৫৭ বছর শেষে শিক্ষকরা অবসরে যান। সরকারি শিক্ষকরা অবসরের পর এক বছর অবসরকালীন ছুটিতে থাকেন। এরপর তাঁরা পেনশন সুবিধার জন্য আবেদন করেন। শিক্ষকরা বলছেন, আবেদনের সঙ্গে প্রথমেই পাঁচ থেকে ১০ হাজার টাকা দিতে হয় সংশ্লিষ্ট অফিস সহকারীকে। এই টাকা না দিলে আবেদন থেকে কাগজগুলো হারিয়ে যেতে থাকে।
সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে কাগজ চূড়ান্ত হয়ে যায় হিসাবরক্ষণ অফিসে। সেখানে 'সেলামি' না দিলে কাগজ গায়েব হয়ে যায়। আর বেসরকারি শিক্ষকরা চাকরি থেকে অবসরের পরেই কল্যাণ তহবিল ও অবসর বোর্ডে আবেদন করেন। সেখানে দিনের পর দিন আবেদন পড়ে থাকে। রাজধানীর পলাশীতে ব্যানবেইস ভবনের নিচ তলার একপাশে রয়েছে তাঁদের জন্য অবসর বোর্ড, অন্য পাশে কল্যাণ বোর্ডের অফিস। এ দুটি অফিসে শিক্ষকদের পেনশন আবেদন ফাইলবন্দি হয়ে পড়ে আছে। কর্মকর্তারা বলছেন, ২০১০ সালের আগস্ট পর্যন্ত তাঁদের কল্যাণ বোর্ডের এবং একই বছরের জুন পর্যন্ত অবসর বোর্ডের টাকা দেওয়া হয়েছে। এরপর টাকার অভাবে চলতি মাস পর্যন্ত অবসরে যাওয়া বেসরকারি শিক্ষকদের আবেদনের নিষ্পত্তি করা যাচ্ছে না।
বেসরকারি শিক্ষকদের পেনশন : গত ১ নভেম্বর অবসর বোর্ডে গিয়ে দেখা যায়, শিক্ষক ও তাঁদের প্রতিনিধিদের ভিড়। সবাই খোঁজ নিতে এসেছেন তাঁদের আবেদনটির কী হলো? মাগুরার নগেন্দ্রনাথ বিশ্বাসকে দেখা গেল ছোটাছুটি করছেন। লালমনিরহাটের সাপ্টীবাড়ী দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন ফজলুর রহমান। ২০০৯ সালে অবসর নেওয়ার পর অবসর সুবিধা পাওয়ার জন্য আবেদন করেন। তাঁর ছেলে স্বপন মিয়া এসেছেন বাবার আবেদনের সর্বশেষ খবর জানতে। অফিসের কর্তারা তাঁকে জানিয়েছেন, তাঁর বাবার ফাইল অনুমোদন হয়ে গেছে। কিন্তু কত মাস পর টাকা পাওয়া যাবে তা বলেননি। হবিগঞ্জের মিরপুর এফএন হাই স্কুলের ধর্মীয় শিক্ষক রবীন্দ্র চক্রবর্তী গত বছরের অক্টোবরে পেনশনের জন্য আবেদন করেন। তদবির করতে করতে এক বছর পরে এসে তিনি শুধু কল্যাণ সুবিধার 'চেক'
পেয়েছেন। অবসর সুবিধা বোর্ডের চেকের খোঁজ নিতে এ নিয়ে তিনি বোর্ড অফিসে কয়েকবার এসেছেন বলে এ প্রতিনিধিকে জানান।
নেত্রকোনা জেলার নোয়াগাঁও আফতাব হোসেন একাডেমীর সিনিয়র সহকারী শিক্ষক সুখরঞ্জন অবসর ভাতার জন্য আবেদন করেছেন ২০০৯ সালের ৬ আগস্ট। আজ পর্যন্ত তাঁর আবেদনটি মঞ্জুর হয়নি। প্রায় দেড় বছর পর তাঁকে জানানো হয়, তাঁর নামের বানানে ভুল রয়েছে। এটি ঠিক করা ছাড়া অবসর ভাতা দেওয়া সম্ভব নয়। পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জের শামীম আহমেদ তাঁর বাবার অবসর ভাতার জন্য ঘুরছেন প্রায় এক বছর ধরে। অবসর বোর্ডে তাঁর সঙ্গে দেখা হয় ব্যানবেইসের নিচ তলায়। শামীম বলেন, 'এ পর্যন্ত কমপক্ষে ১৫ দিন আমি পটুয়াখালী থেকে ঢাকা এসেছি। নানাভাবে আমাকে হয়রানি করা হচ্ছে।'
পটুয়াখালী বাউফল উপজেলার উত্তর কর্পূরকাঠি ইদ্রিসিয়া দাখিল মাদ্রাসার সুপারিনটেনডেন্ট মাওলানা হারুন-অর-রশিদ ২০০৪ সালে লিভার ক্যান্সারে মারা যান। ২০০৬ সালে অবসর ভাতার জন্য তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে আবেদন করা হয়। দীর্ঘদিন ধরে তাঁর ফাইলটি আটকে থাকে। 'এই কাগজ নেই, সেই কাগজ নেই' বলে পরিবারটিকে ঘোরানো হয়। তারপর একদিন বলা হয়, অবসর ভাতা দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ হারুন-অর-রশিদের চাকরির বয়স ১১ বছর হয়নি।
অবসর সুবিধা বোর্ডের বিরুদ্ধে ঘুষ-বাণিজ্যের অভিযোগ বিস্তর। সম্প্রতি সোনারগাঁওয়ের একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক অবসর ভাতার আবেদনের সঙ্গে পাঁচ হাজার টাকা ধরিয়ে দেন। বিষয়টি স্বীকার করেছেন অবসর বোর্ডের সদস্যসচিব অধ্যাপক আসাদুল হক। তিনি অবশ্য বলেছেন, 'মানুষের মনে একটা ধারণা আছে, টাকা না দিলে কাজ হয় না। এ জন্যই এমনটা হচ্ছে।'
আসাদুল হক বলেন, 'সোনারগাঁওয়ের এক স্কুল শিক্ষক আবেদনের সঙ্গে পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছিলেন এ কথা সত্য। আমরা পরে তাঁকে খুঁজেও পাইনি। আগে এ ধরনের কর্মকাণ্ড বেশি হতো। এখন অনেক কমে গেছে। পেনশন মানেই ভোগান্তি_এই কথা এখনো প্রচলিত আছে। তবে ভবিষ্যতে এটা থাকবে না, সে লক্ষ্যে কাজ করছি।'
অবসর বোর্ড সূত্র জানায়, এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রায় পাঁচ লাখ শিক্ষক-কর্মকর্তার অবসরভাগ্য ঝুলে আছে। অবসর সুবিধা বোর্ড এ বাবদ বর্তমান সরকারের কাছে ৬০০ কোটি টাকা চেয়েছিল। একাধিকবার প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেলেও টাকা এখনো পাওয়া যায়নি। নতুন বেতন স্কেল অনুযায়ী জুলাই থেকে প্রতি মাসে অবসর সুবিধার জন্য দরকার হবে কমপক্ষে ৬০ কোটি টাকা। এর মধ্যে শিক্ষক-কর্মকর্তাদের চাঁদার টাকা থেকে পাওয়া যাবে প্রায় ১৬ কোটি টাকা। প্রতি মাসে আরো দরকার হবে ৪৪ কোটি টাকা। তা না পেলে অবসর ভাতার জন্য মাসের পর মাস ঘুরতে হবে আবেদনকারীদের।
অবসর বোর্ডে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় ১৬ হাজার আবেদন পড়ে আছে। প্রতিদিনই ছয় শ থেকে সাত শ আবেদন পড়ছে। সারা দেশে মোট ২৬ হাজার ৬০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এ প্রকল্পের অধীন।
শিক্ষকদের অবসর ভাতার জন্য বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের ১০০ কোটি টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুত ছিল। কিন্তু তিন ধাপে দেওয়া হয়েছিল ৮৯ কোটি টাকা। তবে সঙ্গে শর্ত ছিল, ৮৯ কোটি টাকা খরচ করা যাবে না। এর লাভ থেকে প্রয়োজনীয় খাতে ব্যয় করা যাবে।
অবসর বোর্ডের সচিব আসাদুল হক বলেন, 'আমরা মহা অর্থসঙ্কটে আছি। বর্তমান সরকারকে ৬০০ কোটি টাকা দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছি। কবে এ টাকা পাব জানি না। আগামী মাস থেকে ৬০ কোটি টাকা প্রয়োজন হবে। চাঁদা থেকে পাব ১৬ কোটি টাকা। বাকি ৪৪ কোটি টাকা কোথা থেকে আসবে তা নিয়ে আমাদের চিন্তার অন্ত নেই।'
কল্যাণ বোর্ডের সদস্যসচিব অধ্যক্ষ শাহজাহান সাজু বলেন, ২০১০ সালের আগস্ট পর্যন্ত শিক্ষকদের কল্যাণ ট্রাস্টের পাওনা মেটানো হয়েছে। একই বছরের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে যেসব শিক্ষক অবসর নিয়েছেন এখন তাঁদের পেনশন দেওয়ার কাজ চলছে। তিনি বলেন, ২০১২ সালে শিক্ষকদের অবসর নেওয়ার চাপ থাকবে। যেসব শিক্ষক সত্তরের দশকে চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন, তাঁরা সবাই আগামী বছর অবসর নেবেন। এরপর থেকে চাপ কমবে। তিনি বলেন, সরকারের কল্যাণ ট্রাস্টের টাকা ২০১২ সাল পর্যন্ত আপডেট করতে ৪১২ কোটি টাকা প্রয়োজন। কিন্তু ফান্ডে প্রয়োজনীয় টাকা নেই।
সরকারি শিক্ষকদের পেনশন : সরকারি কলেজের শিক্ষকদের পেনশনের আবেদন করতে হয় মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরে (মাউশি)।
সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আবেদন করতে হয় মাধ্যমিক শিক্ষার আঞ্চলিক উপপরিচালকদের কার্যালয়ে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আবেদন করতে হয় উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে। তিন স্তরের শিক্ষকরা পৃথক তিনটি কার্যালয়ে আবেদন করলেও তাঁদের ভোগান্তির ধরন প্রায় একই।
মাউশির প্রশাসন শাখা জানায়, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক পেনশনের আবেদনটি প্রথমে মাউশির অডিট শাখায় পাঠানো হয়। ২১ দিনের মধ্যে অডিট শেষ করে তা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট বিভাগের উপসচিব ড. খালিদ হোসেন পরের প্রক্রিয়া সম্পর্কে কালের কণ্ঠকে বলেন, মন্ত্রণালয় এক সপ্তাহের মধ্যে পেনশনের কাজ শেষ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের হিসাবরক্ষণ অফিস ৪৫ পুরানা পল্টনে পাঠিয়ে দেয়। মন্ত্রণালয়ে পেনশনের আবেদন জমা থাকে না। আবেদন আসা মাত্র কাজ শেষ করে দেওয়া হয়।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মায়সুর মাহমুদ চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, হিসাবরক্ষণ অফিসেও পেনশনের আবেদন জমা থাকে না। কেন্দ্রীয় হিসাবরক্ষণ অফিসের নির্দেশে পেনশনের আবেদনের নিষ্পত্তি করে অর্থ পাঠানোর বিষয়টি ১০ দিনের মধ্যে শেষ করতে হয় এবং তা প্রতি মাসে কেন্দ্রীয় হিসাবরক্ষণ অফিসে জমা দিতে হয়।
তাঁদের প্রত্যেকেরই দাবি, পেনশন নিয়ে কোনো ভোগান্তি নেই। তবে তাঁরা এটাও বলেছেন, কোনো শিক্ষকের পেনশনের আবেদনে ভুল বা সার্ভিস বুক ঠিক না থাকলে একটু ঝামেলা হয়। সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই ঝামেলা 'একটু' নয়, বেশ বেশি এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তা তৈরি করেন।
হিসাবরক্ষণ অফিসের নথি থেকে দেখা গেছে, গত জুলাই মাসে ২২ জনের পেনশন কেস নিষ্পত্তি করা হয়েছে। কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে এই ২২টির মধ্যে ১৮টি আবেদন হিসাবরক্ষণ অফিসে এসে পেঁৗছাতে সময় লেগেছে তিন মাস। দুটি আবেদন ছয় মাস এবং বাকি দুটি আবেদন আসতে সময় লেগেছে ১৮ মাস। পরের মাস আগস্টে ১৩টি আবেদন নিষ্পত্তি করা হয়েছে। নথিতে দেখা গেছে, এর মধ্যে ১০টি আবেদন হিসাবরক্ষণ অফিসে পেঁৗছাতে সময় লেগেছে ১০ মাস, একটি আবেদন এসেছে ছয় মাসে, এক বছরে এসেছে একটি এবং ১৮ মাসে এসেছে একটি। আর গত সেপ্টেম্বরে ২০টি আবেদন নিষ্পত্তি করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৬টি এসেছে তিন মাসের মধ্যে, ছয় মাসের মধ্যে এসেছে দুটি, এক বছরের মধ্যে এসেছে একটি এবং ১৮ মাসের মধ্যে এসেছে একটি আবেদন।
হিসাবরক্ষণ অফিসের অডিটর জামাল উদ্দিন এ প্রসঙ্গে কালের কণ্ঠকে বলেন, যে শিক্ষক যে তারিখে আবেদন করেছেন, সেই তারিখ থেকে আবেদন হিসাবরক্ষণ অফিসে আসতে যে সময় লেগেছে শুধু তারই ব্যাখা দেওয়া হয়েছে এই পরিসংখ্যানে। তিনি দাবি করেন, হিসাবরক্ষণ অফিসে আসার পর ১০ দিনের মধ্যে প্রতিটি আবেদন নিষ্পত্তি করা হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক কালের কণ্ঠকে জানান, হিসাবরক্ষণ অফিসের এ পরিসংখ্যান থেকেই বোঝা যায় শিক্ষকদের পেনশন প্রাপ্তিতে কত ভোগান্তি হয়।
২০০৯ সালে পেনশনের জন্য অবেদন করেছিলেন অধ্যাপক ইয়াসমিন বানু। আবেদনটি চূড়ান্ত যাচাই-বাছাই শেষে সব দপ্তর পেরিয়ে হিসাবরক্ষণ অফিসে পেঁৗছে চলতি বছরের ৩ মে। হিসাবরক্ষণ অফিস আবেদনটি বিশ্লেষণ করে গত ১৫ মে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়ে জানায়, পেনশন ফরমের ৬ নম্বর পৃষ্ঠায় ৫ দশমিক ৩ অনুচ্ছেদে মঞ্জুরিকারী কর্তৃপক্ষের সিল নেই। আবেদনের সংযোজনী ৮-এর না দাবিপত্রে দপ্তরপ্রধানের সই নেই। ইএলপিসি এবং চাকরির বিবরণীর মূল কপিতে সংযোজন নেই। এ অবস্থায় পেনশন কেসটি নিষ্পত্তি করা যাচ্ছে না।
একইভাবে গত ১৪ জুলাই রাজধানীর কবি নজরুল কলেজ থেকে অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক মুহাম্মদ আবদুল খালেক মিয়া, ৩১ জুলাই রাজধানীর সরকারি তিতুমীর কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক বেগম সাঈদা আক্তার এবং ২৭ অক্টোবর সহকারী অধ্যাপক মো. আনোয়ার হোসেনের পেনশন আবেদনে বিভিন্ন অসংগতি থাকার কথা উল্লেখ করে উল্লেখিত তারিখে হিসাবরক্ষণ অফিস চিঠি দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে। কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয় এখন পর্যন্ত চিঠির জবাব না দেওয়ায় এসব আবেদনের নিষ্পত্তি হচ্ছে না।
ভুক্তভোগী শিক্ষকরা বলছেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শাখা ৬ ইচ্ছে করে এসব আবেদনে ত্রুটি বের করে রাখে। শিক্ষকরা ঠিকমতো কাগজ জমা দিলেও ওই শাখার প্রশাসনিক কর্মকর্তারা তা সরিয়ে ফেলেন। এরপর ওই ত্রুটিযুক্ত আবেদনই হিসাবরক্ষণ অফিসে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
রাজধানীর বিখ্যাত একটি কলেজ থেকে অবসর নেওয়া এক অধ্যাপক ২০০৯ সালে পেনশনের আবেদন করেন। ২০১১ সালে এসেও তাঁর কাজ শেষ হয়নি। দিনের পর দিন এটা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শাখা ৬-এ পড়ে থাকে। তিনি বলেন, একপর্যায়ে আমি ১০ হাজার টাকা দেওয়ার পর আমার ফাইল নড়াচড়া শুরু করে।
শাখা ৬-এর প্রশাসনিক কর্মকর্তা আবদুল মাবুদ মণ্ডল অভিযোগ অস্বীকার করে কালের কণ্ঠকে বলেন, এগুলো মিথ্যা কথা। এখানে আবেদন আসার সঙ্গে সঙ্গে ওপরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এ শাখা থেকে শিক্ষকদের কোনো ভোগান্তিই পেতে হয় না।
মাউশির উপপরিচালক (প্রশাসন) ড. জাহাঙ্গীর হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের আবেদনে কোনো ঝামেলা থাকলেও তা নিরসন করে ২১ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।
অসাধু কর্মকর্তাদের চালিয়াতি ছাড়াও বাস্তবিক কারণেও শিক্ষকদের কাগজপত্র নিয়ে ঝামেলা পোহাতে হয়। শিক্ষকরা যেখানে-যেখানে চাকরি করেন সেখানকার রেকর্ড রাখতে হয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকেই। কিন্তু কর্তৃপক্ষ এ রেকর্ড রাখে না। আর শিক্ষকরাও তা খেয়াল করেন না। চাকরির শেষে যখন পেনশন নেওয়ার সময় আসে তখন এসব বেরিয়ে আসে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পেনশন ভোগান্তি থেকে শিক্ষকদের রেহাই পেতে চাকরি জীবনের রেকর্ড রাখার জন্য ডিজিটাল পদ্ধতির ব্যবহার শুরু হয়েছে। মাউশির কম্পিউটার সেলের শিক্ষকদের এ রেকর্ড রাখার কথা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেখানেও তা ঠিকমতো রাখা হয় না।
এ বিষয়ে মাউশির পরিচালক (মাধ্যমিক) অধ্যাপক মো. শফিকুর রহমান নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, 'আমি পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) ছিলাম। সেখান থেকে বদলি হয়ে ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজের অধ্যক্ষ হই। অধ্যক্ষ হওয়ার আদেশ কম্পিউটার সেলে জমা দিই। আমি তো ভেবেছি ওই ফাইলে আমার নাম লেখা রয়েছে। আমি আর খোঁজ নিইনি। পরে অধ্যক্ষ পদ থেকে বদলি হয়ে মাউশির পরিচালক পদে যোগ দিই। যথারীতি কাগজ জমা দিয়েছি। কিন্তু আমার কর্মস্থল আর আপডেট হয়নি।' তিনি বলেন, "সম্প্রতি মাউশিতে এসব বিষয় নিয়ে একটি কর্মশালায় আমি আমার রেকর্ড দেখানোর অনুরোধ জানাই। সেখানে দেখি আমার বিষয়ে লেখা রয়েছে_ 'অধ্যাপক শফিকুর রহমান, সদস্য (পাঠ্যপুস্তক)।' অথচ ওই সদস্যপদ থেকে বদলি হয়ে আরো দুটি পদে এসেছি। কিন্তু আমার কর্মস্থল আর রেকর্ডে পরিবর্তন হয়নি। এই পরিবর্তন না হওয়াটাই পেনশনের সময় বড় হয়ে দেখা দেয়। আর ভোগান্তির শুরু হয়।"
শফিকুর রহমান বলেন, 'আমি দেখেছি বলে আমার বিষয়টি পরিবর্তন করতে পেরেছি। প্রত্যন্ত এলাকার একটি কলেজের শিক্ষক তো আর নিজে দেখতে পাচ্ছেন না। তাঁর রেকর্ড আপডেট হচ্ছে কি না, তা হয়তো তিনি জানছেন না।'
পেনশন নিয়ে ভুক্তভোগী এক শিক্ষকের (মৃত) সন্তান সাজিদুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, বর্তমানে যেভাবে পেনশন তুলতে হয় তাতে সব 'লস' হয়। তিনি এ পদ্ধতিকে সত্যিকারের ডিজিটালে রূপান্তরের দাবি জানান।
সূত্র: কালেরকণ্ঠ, ০৯/১২/২০১১
No comments:
Post a Comment